কমিউনিজমের পতনের পর রাতারাতি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়লো, তার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এক চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছিল রাশিয়া। পুঁজিবাদের পথে যাত্রা শুরুর জন্য যেসব সংস্কার করা হচ্ছিল তার ফলে জিনিসপত্রের দাম চলে গিয়েছিল মানুষের নাগালের বাইরে, তৈরি হয়েছিল তীব্র খাদ্য সংকট। সেই ঘটনা নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্বটি তৈরি করেছেন বিবিসির ডিনা নিউম্যান। প্রতিবেদনটি পরিবেশন করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন:
১৯৯১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর। সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হলো। সর্বশেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ পদত্যাগ করলেন আনুষ্ঠানিকভাবে।
মিখাইল গর্বাচেভের জায়গায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলেন বরিস ইয়েলৎসিন। তিনি যে নতুন সরকার গঠন করলেন সেখানে অনেক তরুণ এবং উচ্চাকাঙ্খী গবেষককে নিয়ে আসলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সংস্কার করে বাজার অর্থনীতির পথ খুলে দেওয়া।
এদের একজন আন্দ্রে নিচায়েভ। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তাঁকে করা হয়েছিল রাশিয়ার অর্থমন্ত্রী। এর আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক।
“আমাদের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের এটা ছিল এক দারুণ সুযোগ। যে কোন বিচারেই আমাদের মিশনটা ছিল বেশ অভূতপূর্ব। এর আগে এত বিশাল একটা কমিউনিষ্ট রাষ্ট্রকে একটি কার্যকর বাজার অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটানোর চেষ্টা এর আগে হয়নি।”
রাজনীতিতে কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না আন্দ্রে নিচায়েভের। । রাশিয়ার যে অর্থনীতিকে ঠিক করার দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে, সেটার তখন করুণ অবস্থা!
“সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়ার কোন সরকারী প্রশাসনযন্ত্র বলতে কিছু ছিল না। কিছুই না। না ছিল কোন সেনাবাহিনী, কোন সীমান্ত, কোন কাস্টমস। না ছিল কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা মূদ্রা।”
সোভিয়েত কমিউনিজমের যুগে মস্কোতে থাকা আমলাদেরই দায়িত্ব ছিল সারা দেশে কাঁচামাল থেকে শুরু করে সব কিছু সরবরাহ করা। তখন সব কিছুই পুরোপুরি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির অধীনে।
কিন্তু ১৯৯২ সালের শুরুতে কমিউনিস্ট আমলের এই সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়লো। দেশ-বিদেশের সব পর্যবেক্ষকরাই তখন হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলেন যে, রাশিয়া হয়তো সেবারের শীত মৌসুমেই ভেঙ্গে পড়বে। এটাকে ভীতি বা আতংক ছড়ানোর চেষ্টা বলা যাবে না। এই বিপদ ছিল একেবারেই বাস্তব।
মস্কোর হাজার হাজার আমলা তখন সামনে অনিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছু দেখছেন না। তারা তখন কার জন্য কাজ করছেন, সেটাই তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। রাশিয়া – নাকি সোভিয়েত ইউনিয়ন যেটি এখন বিলুপ্ত?
আন্দ্রে নিচায়েভ বলছিলেন, “সব বিদেশি ঋণ তখন আটকে দেওয়া হয়েছে। আমাদের হাতে তখন কোন বৈদেশিক মূদ্রার নগদ তহবিল নেই।”
“বড় বড় নগরীতে তখন খাদ্য সংকট, ক্ষুধার সংকট দেখা দিয়েছে। সেই সব নগরীতে, যেখানে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হতো।”
তিনি বলছেন, “বিশ্বের একসময়ের পরাশক্তি এই দেশটির বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ কোন কোন দিন নেমে আসছিল মাত্র আড়াই কোটি ডলারে! তখন আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ যেখানে এগারো হাজার আটশো কোটি ডলার!”
রাশিয়া তখন প্রবেশ করছে এক অনিশ্চিত সময়ে, একদিকে পেছনে রাখা পুরনো ব্যবস্থা, সামনে বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্যের আশংকা। যে আশংকার কথা গর্বাচেভ বার বার বলেছেন।
তখন কী করছিলেন অর্থমন্ত্রী আন্দ্রে নিচায়েভ?
“সবাই জানতো যে এ অবস্থায় কিছু জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। দেশ তখন ভেঙ্গে পড়ছে। ক্ষুধার সংকট বাস্তবেই দেখা দিয়েছে।”
“তখন আমাদের সামনে বিকল্প কী? দেশ অচল হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা? নাকি জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটা তুলে নেওয়া?”
আন্দ্রে নিচায়েভ বৈপ্লবিক সংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। এজন্যে তিনি অজনপ্রিয় পদক্ষেপ নিতেও প্রস্তুত ছিলেন। এর পরিণতি যাই হোক না কেন।
“আমরা যখন সরকারে যোগ দেই, তখন আমাদের ধারণা ছিল, হয়তো বড় জোর এক বা দুই মাসের জন্য থাকবো, এরপর আমাদের বরখাস্ত করা হবে।”
“আমরা সবচেয়ে কঠোর ব্যবস্থা বা সবচেয়ে অজনপ্রিয় পদক্ষেপ নিতেও প্রস্তুত ছিলাম। আমাদের পর অন্যরা এসে হয়তো একটা যথাযথ বাজার অর্থনীতি গড়ে তুলবে।”
প্রথম সংস্কারবাদী সরকার যেন তাই বেশ কিছুটা তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিল। খাদ্য এবং অন্যান্য জিনিসের ওপর থেকে কমিউনিস্ট যুগের ভর্তুকি রাতারাতি তুলে নেওয়া হলো।
১৯৯২ সালের পহেলা জানুয়ারি রাশিয়ার মানুষ দোকানে গিয়ে দেখলেন, এক রাতেই সব জিনিসের দাম আকাশচুম্বী। সেসময় মস্কোতে নিযুক্ত বিবিসির সংবাদদাতা নিজের চোখে দেখেছেন রুশ অর্থনীতিতে এই ‘শক থেরাপি কিভাবে কাজ করেছে।
তার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, দশকের পর দশক ধরে চলা কৃত্রিম ভর্তুকি তুলে দেওয়ার পর দোকানে গিয়ে রাশিয়ার লোকজনের চোখ যেন ছানাবড়া। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তারা দেখছিলেন, কিভাবে একেবারে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম পর্যন্ত তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
এক কেজি হ্যাম বা শুকরের মাংসের দাম তখন দাঁড়িয়েছে এক হাজার রুবলে, যা কিনা সেসময় রাশিয়ায় একজন গড়পড়তা মানুষের দু’মাসের বেতনের সমান। সসেজের দাম একশো রুবল, বা প্রায় এক সপ্তাহের বেতনের সমান।
লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি যে রাশিয়ার মানুষকে রাতারাতি দারিদ্রসীমার কাছে নামিয়ে আনলো। অনেকেই তাদের ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতে রাস্তায় নামলেন।
কেউ কেউ তখন মজুতদারির ব্যবসায় জুটে গেল। তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মজুত করে এক বা দু’সপ্তাহ পরে অনেক উচ্চ মূল্যে বিক্রি করছিল। বৃদ্ধা মহিলারা বাড়িতে বসে টুপি বা হাতমোজা বুনে সেসব বিক্রি করছিলেন রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে।
কিন্তু এই নিদারুণ দৃশ্য দেখেও তার মধ্যে নাকি আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন সেসময়ের অর্থমন্ত্রী আন্দ্রে নিচায়েভ।
“আপনাকে বুঝতে হবে, যে দেশটা কার্যত ভেঙ্গে পড়েছে, যে দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে, আপনি যদি সেই দেশের সরকার চালানোর দায়িত্বে থাকেন, যদি বৃদ্ধ লোকজনকে আপনি অবসর ভাতা পর্যন্ত দিতে না পারেন, তখন তারা যে এভাবে জীবনধারণের একটা উপায় খুঁজে বের করেছে, নিজেদের দক্ষতাকে কাজে লাগাচ্ছে, সেটা কী ভালো নয়?”
“তারা যে হাতমোজা বুনে রাতের খাবার কেনার মতো কিছু আয় করছিল, সেটা কী ভালো নয়?”
তবে রাস্তায় যারা এরকম ব্যবসায় নেমেছিলেন, তাদের সবাই আমদানি করা বিদেশি পণ্য অনেক চড়া মূল্যে বিক্রি করছিলেন। এ অবস্থায় দারিদ্রক্লিষ্ট হাজার হাজার রুশ নাগরিক রাস্তায় নামলেন বিক্ষোভ করতে।
কিন্তু এই বিক্ষোভ সত্ত্বেও সরকার তাদের সংস্কার অব্যাহত রাখলো। এর ফলে সাধারণ মানুষের দু:খ দুর্দশা আরও বাড়লো। মাত্র এক বছরের মধ্যেই রাশিয়ার শিল্পোৎপাদন বিশ শতাংশ কমে গেল।
রাশিয়ার শিল্প এবং সামরিক যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবসায় ধস নামলো। তবে সেসময়ের অর্থমন্ত্রী আন্দ্রে নিচায়েভ বলছেন, এটি এড়ানোর কোন উপায় তাদের সামনে ছিল না।
“সামরিক যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। আমি আপনাকে একটা উদাহারণ দেব।”
“একবার আমি সাইবেরিয়ার ওমস্কে গেলাম একটি ট্যাংক তৈরির কারখানা দেখতে। আমি কারখানার পরিচালককে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, এই কারখানাটি এখন বেসামরিক কাজের উপযোগী কিছু তৈরির কারখানায় রূপান্তর করা দরকার। কিন্তু তিনি আমাকে অনুনয় বিনয় করছিলেন, দয়া করে দেখুন, আমরা কী চমৎকার ট্যাংক তৈরি করি।”
আন্দ্রে নিচায়েভ বলছিলেন, “এই কারখানার কর্মীরা আসলেই চমৎকার ট্যাংক তৈরি করেন। নাম দ্য ব্ল্যাক ঈগল, বা কালো ঈগল। এটি একটি দারুণ অস্ত্র, একই সঙ্গে এটি লাফাতে পারে, এবং গোলা ছুঁড়তে পারে।”
ট্যাংক দেখে তিনি বিমোহিত হয়ে গেলেন। কিন্তু কারখানা ঘুরে কাছের জঙ্গলে গিয়ে দেখলেন, সেখানে মাইলের পর মাইল শত শত সাধারণ ট্যাংক তুষারের নীচে ঢাকা পড়ে আছে।
“আমাদের দেশ তখন প্রচন্ড খাদ্য সংকটের মুখে। আর এই লোকগুলো তখনো পর্যন্ত ট্যাংক বানানো ছাড়া আর কিছু করতে পারছে না।”
“আমাদের তৈরি ট্যাংক হয়তো সেসময়ের বিশ্ব সেরা। কিন্তু আমাদের বাজেটের অবস্থা তখন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়। আমি তখন নির্দেশ দিলাম ঐ কারখানায় একেবারে অত্যাধুনিক তিন ধরণের ট্যাংক ছাড়া আর সবধরণের ট্যাংক তৈরি বন্ধ করে দিতে হবে।”
এই সংস্কারের জের ধরে বহু দশকের মধ্যে রাশিয়ায় এক বিরাট সম্পদ বৈষম্য তৈরি হতে লাগলো। এক নব্য ধনিক শ্রেণী তৈরি হলো।
আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন মানের অবনতি ঘটতে থাকলো। অনেক মানুষের কোন রকমে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকাই দুস্কর হয়ে পড়লো। এরপর ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার কংগ্রেস অব ডেপুটিজ বা জনপ্রতিনিধিদের কংগ্রেসে সংস্কারবাদী সরকারের পদত্যাগের দাবি উঠলো।
সংস্কারের গতি ধীর করে আনার জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকলো। প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন প্রথমে তার সংস্কারবাদী প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করলেন। এরপর বরখাস্ত করলেন অর্থমন্ত্রী আন্দ্রে নিচায়েভকে।
রাশিয়ার প্রথম সংস্কারবাদী সরকার টিকেছিল এক বছরেরও কম সময়। তারা যা আশা করেছিল, তার চেয়ে অনেক দীর্ঘ সময়। আন্দ্রে নিচায়েভ অবশ্য গর্বিত তাদের কাজ নিয়ে।
“লোকে বলাবলি করে, নব্বই এর দশকটা তাদের জন্য কত কঠিন ছিল, যেসব ভুল তখন করা হয়েছে, ক্ষমতার যে অপব্যবহার হয়েছে।”
“কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেই প্রথম রাশিয়ার মানুষ ব্যবসা শুরু করেছে। একটা বাজার সৃষ্টি করার জন্য, তাদের ক্রেতাদের কাছে খাবার বা কাপড় বিক্রির জন্য।”
“তারা কিন্তু নিজেদের উদ্যোগে এটা করেছেন। কোন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ছাড়া। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমি যা করেছি তার জন্য আমি গর্বিত। আমি এদেশ থেকে জিনিসপত্রের ঘাটতি দূর করেছি।”
রাশিয়ার এই চরম অর্থনৈতিক সংকট অব্যাহত ছিল পুরো নব্বই এর দশকের প্রথম ভাগ জুড়ে। মূদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তীব্র সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিরতা — সব মিলিয়ে সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদের পথে রাশিয়ার প্রথম কয়েক বছর ছিল দেশটির মানুষের জন্য এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা।
সূত্র, বিবিসি